SATT ACADEMY

New to Satt Academy? Create an account


or

Log in with Google Account

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব | NCTB BOOK

পলাশি যুদ্ধের পর মীর জাফরকে নামেমাত্র নবাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ যে উদ্দেশে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসিয়েছিল, তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। নতুন নবাব কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে । নিজের ক্ষমতা রক্ষা করতেও তাকে বার বার ক্লাইভের ওপর নির্ভর করতে হয় । আবার ক্লাইভের রাজকার্যে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ নবাবের পছন্দ ছিল না। ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য মীর জাফর আরেক বিদেশি কোম্পানি ওলন্দাজদের সাথে আঁতাত করে। বিষয়টি ইংরেজদের দৃষ্টি এড়ায়নি । মীর জাফরের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে অক্ষমতা এবং ওলন্দাজদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় । ১৭৬০ সালে ইংরেজ গভর্নর ভান্সিটার্ট মীর জাফরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মীর কাশিমকে শর্ত সাপেক্ষে সিংহাসনে বসান । ক্ষমতারোহণের পর মীর কাশিম স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন । ফলে ইংরেজদের সাথে তাঁর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ।

 

বক্সারের যুদ্ধের কারণ:

মীর কাশিম একজন সুদক্ষ শাসক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন । তিনি তাঁর প্রজাদের কল্যাণের প্রতি সচেতন ছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে সম্মানজনক উপায়ে বাংলার স্বার্থ রক্ষা করে আর্থিক ও সামরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে । এ উদ্দেশে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলোই শেষ পর্যন্ত বক্সারের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । যেমন:

  • মীর কাশিম প্রথমে ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । এ উদ্দেশ্যে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন । নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ ও রাজধানীর চারদিকে পরিখা খনন করেন ।
  • ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা এবং সৈনিকদের ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্য দুইজন ইউরোপীয় সৈনিককে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন ।
  • অস্ত্র-গোলাবারুদের জন্য যেন অন্যের মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সেজন্য রাজধানীতে কামান, বন্দুক ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ।
  • বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণ ইংরেজদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে পদচ্যুত ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করেন ।
  • ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাটের ফরমানে ইংরেজদের ব্যবসা করার যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তারা তার অপব্যবহার করে । ‘দস্তক' নামের ছাড়পত্রের অপব্যবহারের ফলে দেশি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন । ফলে, নবাব সবার জন্য আন্তঃবাণিজ্যে শুল্ক উঠিয়ে দেন। এজন্য ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের একচেটিয়া লাভজনক ব্যবসায় অসুবিধা হয়। এ বিষয়ে নবাব কোনোরকম আপোস করতে না চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে ।
  • নবাবের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল দেশ ও জনগণের স্বার্থে, যা ইংরেজদের স্বার্থপরিপন্থী । ফলে ক্ষুব্ধ ইংরেজরা এর প্রতিকারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
  • ১৭৬৩ সালে ক্ষুব্ধ হয়ে পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ এলিস দখল করে নেয় । ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা ছাড়া নবাবের আর কোনো উপায় থাকে না। মীর কাশিম সফল প্রতিরোধের মাধ্যমে এলিসকে পাটনা থেকে বিতাড়িত করেন।  ১৭৬৩ সালে কোলকাতা কাউন্সিল নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মেজর এডামসের নেতৃত্বে প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর কাছে গিরিয়া, কাটোয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে নবাব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন ।

ইতোমধ্যে ইংরেজরা মীর জাফরকে পুনরায় বাংলার সিংহাসনে বসায় । মীর কাশিম পরাজিত হয়েও হতাশ হননি । নবাব ইংরেজদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন । তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৭৬৪ সালে বিহারের বক্সার নামক স্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন । দুর্ভাগ্যক্রমে সম্মিলিত বাহিনী মেজর মনরোর কাছে পরাজিত হয় ।

মীর কাশিমের পরাজয়ের কারণে বাংলার সার্বভৌমত্ব উদ্ধারের শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইংরেজ শক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলা তথা উপমহাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে থাকে । এ কারণে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধের চেয়ে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি ।

 

বক্সারের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নাম ও দেশের নাম:

            নাম                        দেশ
       মীর কাশেম               ইংল্যান্ড
     সম্রাট শাহ আলম                 বাংলা
      মেজর মনরো               অযোধ্যা
     সুজাউদ্দৌলা                   দিল্লি

 

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল :

১. এ যুদ্ধের ফলে মীর কাশিমের স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয় । উপমহাদেশে ইংরেজদের প্রভাব- প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । বিনা বাধায় তারা আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে ।

২. এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যান। দিল্লির সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেন । মীর কাশিম পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন । ১৭৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয় ।

৩. ইংরেজরা অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে কারা ও এলাহাবাদ হস্তগত করতে সক্ষম হয় ।

৪. এ যুদ্ধের ফলে শুধু বাংলার নবাবই পরাজিত হননি, তাঁর মিত্র ভারত সম্রাট শাহ আলম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাও পরাজিত হন । এই তিন শক্তির একসঙ্গে পরাজয়ে ইংরেজদের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধি পায় ।

৫. এ যুদ্ধের ফলে রবার্ট ক্লাইভ দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে । ফলে বাংলায় ইংরেজ অধিকার আইনত স্বীকৃত হয় এবং তারা অসীম ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকে । শুরু হয় প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন।

 

Content added By